ভুয়া’ মুক্তিযোদ্ধা সনদে চট্টগ্রাম বন্দরে চাকরি!
চট্টগ্রাম বন্দরের সহকারী ফায়ার ব্রিগেড ইন্সপেক্টর ইফফাত সরোয়ার শাওন ২০১৭ সালে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটায় চাকরি পান। তবে তার বাবা সরোয়ার কামাল ওরফে লাতু মুক্তিযোদ্ধাই নন বলে অভিযোগ তুলেছেন, যাদের তিনি সহযোদ্ধা হিসেবে বলছেন তারাই। সরোয়ার কামালকে ‘ভুয়া’ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে উল্লেখ করে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয়েও অভিযোগ করেছেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বহুবার এই অভিযোগ উপজেলা পর্যন্ত এলেও কোনো তদন্তই করা হয়নি। তবে ইফফাত সরোয়ার শাওনের দাবি, তিনি কোটায় নয়, মেধায় চাকরি পেয়েছেন।
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালে সহকারী ফায়ার ব্রিগেড ইন্সপেক্টরের তিনটি শূন্য পদে লোক নিয়োগের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। বিজ্ঞপ্তির পর মোট ৭৫টি আবেদনপত্র পাওয়া যায়। সেখান থেকে ৫১ জন প্রার্থীকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের স্টেডিয়ামে শারীরিক যোগ্যতা যাচাই পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য রেজিস্টার্ড ডাকযোগে প্রবেশপত্র পাঠানো হয়। আটজনকে ৭৫ নম্বরের লিখিত ও ২৫ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য ইন্টারভিউ কার্ড পাঠানো হয়। লিখিত পরীক্ষায় মোট তিনজন প্রার্থী প্রচলিত বিধি মোতাবেক ৫০ শতাংশ বা তদূর্ধ্ব নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হন। উত্তীর্ণ তিন প্রার্থী মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেন। ইফফাত সরোয়ার শাওন সেদিন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটায় লিখিত পরীক্ষায় ৫১ এবং মৌখিক পরীক্ষায় ১৮ নম্বরসহ মোট ৬৯ পেয়ে নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ৯৩০০-২২৪৯০ বেতন স্কেলে এরপরই যুক্ত হন সহকারী ফায়ার ব্রিগেড ইন্সপেক্টর পদে। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটায় চাকরি পেলেও এখন আর তিনি সেই তথ্য স্বীকার করছেন না। কালবেলাকে তিনি বলেন, ‘আমি মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নয়, নিজের মেধায় চাকরি পেয়েছি। কোটার প্রয়োগটা শুধুই ফরমালিটি (আনুষ্ঠানিকতা) ছাড়া আর কিছু না। আমার বাবার ভারতীয় তালিকায় নাম নেই। সে হিসেবে লাল মুক্তিবার্তাকে রেফারেন্স হিসেবে ধরেই কর্তৃপক্ষ সব ভেরিফিকেশন সম্পন্ন করে আমাকে সম্পূর্ণ স্বচ্ছতার ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়।’
তবে তার নিয়োগ বোর্ডের নির্বাচনী কমিটির সভার কার্যবিবরণীর প্রথম ও দ্বিতীয় পাতায় নির্বাচনী কমিটির আহ্বায়ক, সদস্য সচিব ও দুজন সদস্য তাকে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটায় চাকরি দেওয়ার সুপারিশ করে স্পষ্টভাবে স্বাক্ষর করেছেন।
এই বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা কোটায় যারা চাকরি পেয়েছেন, তাদের একটি তালিকা এরই মধ্যে আমরা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। বাস্তবিক অর্থে কেউ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট দিয়ে চাকরি পেয়ে থাকলে আইনগতভাবেই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাশাপাশি চাকরি থেকেও বরখাস্ত করা হবে।’
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালক (নিরাপত্তা) লে. কর্নেল মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘এমন অভিযোগ এলে বিভাগীয় তদন্ত হবে। এরপর বন্দর প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে।’
জানা যায়, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় বেশ কয়েকটি সনদ। এর মধ্যে রয়েছে মুক্তিবার্তা, কল্যাণ ট্রাস্ট ও বেসামরিক গেজেট; কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের এই তিন তালিকার মধ্যে সরোয়ার কামালের নাম সংযুক্ত রয়েছে শুধু মুক্তি বার্তায়, যার নম্বর ১২০৩০৫০-২২৫। বাকি সব সনদের বিষয়ে জানা নেই এই ‘বীর মুক্তিযোদ্ধার’।
এ বিষয়ে সারোয়ার কামাল বলেন, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিন ছিলেন তার কমান্ডার।’ এরপর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত বই ঘেঁটে দেখা যায় জসিম উদ্দিনের যে ছবি দেখিয়েছিলেন সরোয়ার কামাল, সেখানে তার নাম লেখা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নায়ক শফিউল আলম। সরোয়ার কামালের বক্তব্যের সঙ্গে কমান্ডারের তথ্যটি মিল না পেয়ে পরদিন আবার কথা হয় সরোয়ার কামালের সঙ্গে। এরপর তিনি বলেন, জসিম উদ্দিন নয়, তার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ছিলেন কাজী সিরাজ। এক পর্যায়ে যুদ্ধের সময় তার কয়েকজন সহযোদ্ধার কথা জানতে চাইলে তিনি তিনজনের নাম বলেন। দেখা যায়, তার বলা দুজন মুক্তিযোদ্ধাই জীবিত নেই, যিনি জীবিত, তার নাম মাখন লাল। বীর মুক্তিযোদ্ধা মাখন লাল স্পষ্ট জানিয়ে দেন সরোয়ার কামাল ওরফে লাতু তার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি। পরে নিজেকে অসহায় দাবি করে কালবেলার প্রতিনিধিকে সংবাদটি না করার অনুরোধ জানান সরোয়ার কামাল।