বাংলাদেশে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও বিশ্বে গণহত্যা বন্ধের আহ্বান জানালেন দেশি-বিদেশি গবেষকরা। ‘বাংলাদেশের ৫০ বছরের পথচলা : গণহত্যা, জাতিরাষ্ট্র এবং বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাশার বাংলাদেশ’ শিরোনামের দুই দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এ আহবান জানান তারা।
গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র এবং বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনীর যৌথ উদ্যোগে বৃহস্পতিবার বাংলা একাডেমিতে শুরু হয় দুই দিনের এ সম্মেলন। একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে এ সম্মেলনের উদ্বোধন করেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন লে. কর্নেল (অব.) সাজ্জাদ আলী জহির বীরপ্রতীক। শুভেচ্ছা বক্তৃতা করেন ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক মানস ঘোষ।
গণহত্যা জাদুঘরের সভাপতি মুনতাসীর মামুনের সভাপতিত্বে এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন। দুই দিনের এ সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন কানাডা, নিউজিল্যান্ড, তুরষ্ক, ভারত, নেপাল, শ্রীলংকা, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশের ২৫ জন বিশেষজ্ঞ গবেষক।
মূল প্রবন্ধে বিনায়ক সেন বলেন, বঙ্গবন্ধু গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের দার্শনিক ভাবনাকে বাস্তবায়িত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে গিয়েছেন। অনেক ফ্রন্টে লড়তে হচ্ছিল বঙ্গবন্ধুকে। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ- এসব নিয়ে লড়াই তো ছিলই। কিন্তু তার সাথে যুক্ত হয়েছিল অতি বামপন্থার অন্তর্ঘাতী তৎপরতা ও অতি-ডানপন্থি উগ্র মতবাদের সাথে বাড়তি লড়াইয়ের চাপ। গণতন্ত্রের পথে সমাজতন্ত্রের নির্মাণের ক্ষেত্রে যে ধরনের সামাজিক সুস্থিরতা ও সামাজিক সহিষ্ণুতার প্রয়োজন, সে ধরনের সামাজিক পুঁজি ক্রমশ ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছিল, এসব শক্তির অশুভ তৎপরতার দ্বারা।
তিনি আরো বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতির জনককে আমরা রাষ্ট্র চালানোর জন্য, তার আকাক্সক্ষার গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের জন্য চার বছর সময়ও দেইনি, দিতে চাইনি।
কেএম খালিদ বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী স্বাধীনতাকামী বাঙালি জাতি দমনে যে নিকৃষ্ট পন্থা বেছে নিয়েছিল সেটি ছিল গণহত্যা, দমন ও নির্যাতন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর মুক্তিযুদ্ধ শব্দটি মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ঘাতক দালালদের পুনর্বাসিত করা হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই গণহত্যা শব্দটি আড়ালে পড়ে গিয়েছিল। গণহত্যা ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল যাতে ঘাতকরা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়, স্বীকৃতি পায়।
তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। স্বল্প সময়ে দেশকে আধুনিক একটি সংবিধান উপহার দিয়েছেন। তিনি চেয়েছিলেন অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলা গড়তে এবং এ লক্ষ্যে কাজও শুরু করেছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতক অপচক্র তাকে সেই সময় দেয়নি। পিতার অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করে একটি আধুনিক ও উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণের লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন আমাদের প্রিয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। গণহত্যা আর্কাইভ ও জাদুঘর প্রতিষ্ঠা সেই লড়াইয়েরই একটি অংশ; যা মহান মুক্তিযুদ্ধের শহিদদের আত্মত্যাগের কাহিনী আমাদের স্মরণ করিয়ে দেবে।
সভাপতির বক্তব্যে মুনতাসীর মামুন গণহত্যা জাদুঘর গড়ে ওঠার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেন। তিনি বলেন গণহত্যা জাদুঘর কেবল নিদর্শন প্রদর্শনের কাজই করছে না, বরঞ্চ মাঠ পর্যায়ে যে গবেষনা চালাচ্ছে সেটা বদলে দিচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসচর্চার গতিপথ।
তিনি আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধের প্রধান বৈশিষ্ট্য গণহত্যা-নির্যাতন। একের অধিক মানুষ হত্যাকেই চিহ্নিত করা হয়েছে গণহত্যা হিসেবে। নির্যাতনের অন্তর্গত শারীরিক নির্যাতন, ধর্ষণ ও দেশ ত্যাগে বাধ্য করা। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বগাথা সবচেয়ে বেশি আলোচিত এবং তা স্বাভাবিক। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কোনো একটি দেশে এতো অল্প সময়ে এতো মানুষ হত্যা করা হয়নি। যদিও আমরা বলি ৩০ লক্ষ শহিদ হয়েছেন, কিন্তু মনে হয় সংখ্যাটি তারও বেশি। গণহত্যা, বধ্যভূমি, নির্যাতন মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে একেবারে নেই তা নয় কিন্তু গুরুত্ব ততটা এর ওপর দেওয়া হয়নি। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগের ব্যাপারটি আড়ালে পড়ে যায়।
মুনতাসীর মামুন বলেন, ৩২টি জেলায় গণহত্যা-বধ্যভূমি-গণকবর-নির্যাতন কেন্দ্রের সংখ্যা যদি হয় ১৬ হাজার ৪৫৮ তাহলে সবগুলো জেলার কাজ শেষ হওয়ার পর সে সংখ্যা কততে উন্নীত হতে পারে আন্দাজ করা যাচ্ছে। হয়তো বা শহিদের সংখ্যা ত্রিশ লক্ষ ছাড়িয়ে যেতে পারে। উল্লেখ্য, শহিদের সংখ্যার হিসেবের সাথে শরণার্থীদের মৃত্যুর সংখ্যাটাকে যুক্ত করতে হবে। ফলে আশা করা যায়, বাংলাদেশে গণহত্যার সংখ্যাতাত্ত্বিক যে ‘জনপ্রিয়’ বিতর্ক ও একে কেন্দ্র করে যে রাজনীতি চালু আছে তার অবসান হবে। এ সময় তিনি বিশ্বব্যাপী গণহত্যা বন্ধের আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, গণহত্যা-নির্যাতন এখনও বন্ধ হয়নি। শক্তিশালী দেশগুলোর স্বার্থে এখনও তা চলছে, যা বিশ্বে শান্তি স্থাপন সুদূর পরাহত করে তুলছে। বর্তমানে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যা এর প্রমাণ। অনেক জায়গায় ঘাতকদের বিচারও হয় নি, হচ্ছে না বা হয়তো হবেও না। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বর্তমান আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করছি যেখানে দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞরা যোগ দিচ্ছেন। আমরা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার আলোকে এ আবেদন জানাতে চাই গণহত্যা বন্ধ হোক। মানবিকতা বিরাজ করুক।
মোট ৪টি একাডেমিক অধিবেশনে দেশ ও বিদেশের গবেষকগণ তাদের প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
প্রথম অধিবেশনে প্রধান অতিথি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রী আ.ক.ম. মোজাম্মেল হক। আর চতুর্থ অধিবেশনে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা মন্ত্রী এম. এ. মান্নান
অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশের শিল্পীদের অঙ্কিত ৬টি চিত্রকর্ম লেখক ও সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির গণহত্যা জাদুঘরকে উপহার প্রদান করেন। গণহত্যা জাদুঘরের পক্ষ থেকে উপহার গ্রহণ করেন জাদুঘরের সভাপতি মুনতাসীর মামুন
সূত্র ঃ যুগান্তর ০২ এপ্রিল