ঘাটাইলে ১২১৩ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ৮ শতাধিক ভুয়া
টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ছিল চার শতাধিক। কিন্তু বর্তমানে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২১৩ জন। তারা ভাতাসহ সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। অতিরিক্ত এই আট শতাধিক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা নানা অপকৌশলে মুক্তিযোদ্ধার তালিকাভুক্ত হয়েছেন বলে দাবি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের।
এসব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সনদ বাতিল ও ভাতা বন্ধের দাবিতে বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাত হোসেন অভিযোগ দায়ের করেছেন। পরে অভিযোগের ভিত্তিতে তথ্য যাচাই বাছাই অনুষ্ঠিত হলেও কিছু অসাধু মুক্তিযোদ্ধার সাফাই সাক্ষীর ফলে তারা বহাল তবিয়তে থেকে যান। ফলে এসব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা এখনো ভাতা উত্তোলনসহ সব প্রকার সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে আসছেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাত হোসেন বলেন, ১৯৭১ সালে ঘাটাইল উপজেলায় ৪০০ কয়েকজন মাত্র মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা ১৯৭২ সালে সন্মেলন করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় সেই তালিকা এখন উধাও হয়ে গেছে।
উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ঘাটাইলে উপজেলায় স্বেচ্ছাসেবকসহ ৪৬৫ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এখন ভাতা তুলছেন ১২১৩ জন। এটা রাষ্ট্রদ্রোহিতার সামিল। প্রায় আট শতাধিক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়ে খোঁজখবর নিতে অনুসন্ধানে নামে ‘ডেইলি বাংলাদেশ’।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ও নাতি-পুতিদের জন্য রাষ্ট্রিয় দাঁড় উন্মুক্ত থাকায় উপজেলার কিছু সুবিধাবাদী লোক মুক্তিযোদ্ধার তালিকাভুক্ত হতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। তারা জেলা ও উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের দায়িত্বরত কর্মকর্তা ও তাদের সহযোগীসহ একটি চক্রের সঙ্গে মোটা অংকের টাকা লেনদেন করে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হন।
ঘাটাইল উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল বাছেদ করিম বলেন, আমি একজন প্রকৃত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাস থেকে রাষ্ট্রীয় ভাতাসহ সব সুবিধা ও জাতীর শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে সন্মান পেয়ে আসছিলাম। কিন্তু পরিতাপের বিষয় ২০১৯ সালের নভেম্বর মাস থেকে আমার সেই ভাতা বন্ধ করে দেওয়াসহ সব কিছু কেড়ে নেয় আ.লীগ সরকারের কিছু স্বার্থান্বেষী মহল। যারা মুক্তিযোদ্ধা নয় তারা আমাকে সমাজে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য অত্যন্ত কৌশলে এই কাজটি করেছে। যা আজও ঘাটাইলের মুক্তিযোদ্ধারা মেনে নিতে পারেনি।
তিনি আরো বলেন, আমাদের মতো অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের বাদ দিয়ে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের স্থান করে দিয়েছে সরকারের কিছু দালাল, আমলা ও আওয়ামী এজেন্টরা। যথাযথ কর্তৃপক্ষকে আমি অনুরোধ করব আমার মতো প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যারা সু-দীর্ঘকাল রাষ্ট্রীয় সন্মানি ভাতা পেয়েছে আবার সেই ভাতাটা যেন চালু করা হয়। অনেকেই যুদ্ধ না করে অর্থের বিনিময়ে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে সরকারের কাছ থেকে ভাতা পাচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে যেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়।
ভারতীয় ট্রেনিংপ্রাপ্ত কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মজিবর রহমান বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাইরে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করি। ঘাটাইলে আমরা ৪০০ মুক্তিযোদ্ধা ভাতা উত্তোলন করতাম। এখন ১২ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পায়। এরা কারা। কোথা থেকে এলো এরা। কে বানালো তাদের মুক্তিযোদ্ধা। এদের বিচার হওয়া জরুরি। আমি বর্তমান সরকারের কাছে বিনীত অনুরোধ করব, যারা ৮ শতাধিক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং সরকারি কোষাগার থেকে মাসের পর মাস ভাতা দিয়ে যাচ্ছে তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হোক।
দিঘলকান্দি ইউনিয়নের কোলাহা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা হায়দার আলী হিরা বলেন, ঘাটাইল উপজেলায় বহুবার মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি গঠিত হয়েছে। প্রতি বারই তাদের নিকট আত্মীয়, নেতা, ভাই, খালু, চাচা, বোনের জামাতা ও প্রভাবশালীদের মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় যুক্ত করেছেন। ওই সব মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের মধ্যে অনেকে আজ সরকারের বিভিন্ন দফতরে বড় বড় পদে চাকরি করছেন। ঘাটাইলে মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে যে পরিস্থিতি এখন মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিতে অপমান ও লজ্জাবোধ করি।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান খান বলেন, আমরা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারাই ঘাটাইলে প্রথম মুক্তিযোদ্ধা সংসদ বানাই। সেসময় ৪ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা পেয়েছিলাম। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে দলীয় কারণে, দলীয় প্রভাব খাটিয়ে তাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা বানানো হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেক মুক্তিযোদ্ধা জানান, বিএনপি ও আ.লীগ ক্ষমতায় আসলে ঘুরে ফিরে প্রত্যেকেই যার যার সুবিধা মতো ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা ভুক্ত করেছেন। তবে এসব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার বেশি অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে ২০১৭ সালের আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ের মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটির বিরুদ্ধে। ওই সময় প্রায় ৮ শতাধিক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে অনৈতিক লেনদেন করে বাছাই কমিটির সদস্যরা একেক জন সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। ফলে ওই বাছাই কমিটির সদস্য সচিব তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবুল কাশেম মুহাম্মদ শাহীন বাছাই কমিটিতে স্বাক্ষর না করে অনিয়মের বিষয়টি লিখিত আকারে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেন। পরে ওই বাছাই কমিটির কাছে ২৩ জন চিহ্নিত রাজাকার, ৫২ জন অযুদ্ধহত মুক্তিযোদ্ধা এবং ২১ জন ভুয়া শহিদ মুক্তিযোদ্ধা চিহ্নিত হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। উল্টো তাদের অনেকের বন্ধ ভাতা চালু করার সুপারিশ এবং ভাতা উত্তোলনের ব্যবস্থা করে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
এসব অনিয়মের বিষয়ে ঘাটাইল উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার তোফাজ্জল হোসেন কাছে জানতে চাইলে তিনি প্রশ্ন এড়িয়ে যান এবং বলেন, নিজেদের সন্মান রক্ষার্থে এ সময়ে আমি কোনো বক্তব্য দেব না।
এ বিষয়ে ঘাটাইল উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের দায়িত্বপ্রাপ্ত সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইরতিজা হাসান বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই বাছাই বিষয়টি পরিচালিত হয় জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের মাধ্যমে। ঘাটাইলে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে এসব অভিযোগের আলোকে যদি লিখিত আকারে পাই, তাহলে সেই অভিযোগ জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে পাঠিয়ে দেব। কর্তৃপক্ষের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
সূত্র ডেইলি-বাংলাদেশ