মুক্তিযোদ্ধাদের আদর্শগত বিভক্তি: সময়ের দাবি।
এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, জাতিকে স্বৈরাচারী সরকার শেখ হাসিনা ও তার অত্যাচারী প্রশাসনের শাসন থেকে মুক্ত করার সংগ্রামে ছাত্র, জনতা এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণ থাকলেও, মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠনগুলোর ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্যভাবে অনুপস্থিত। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চের দলবদ্ধ উপস্থিতি এ ঐতিহাসিক আন্দোলনে চোখে পড়েনি। যাদের আত্মত্যাগে এ দেশ স্বাধীন হয়েছিল, তাদের এ নীরবতা শুধু হতাশাজনকই নয়, নিন্দনীয় এবং বেদনাদায়কও।
আমার মতে, মুক্তিযোদ্ধাদের এই অধঃপতনের প্রধান কারণ হলো, নানাবিধ লোভ এবং ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থে নিজেদের গৌরবময় অবদান ভুলে গিয়ে আদর্শহীন রাজনীতির অনুসরণ। যদিও কিছু মুক্তিযোদ্ধা, আমার মতো, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কণ্ঠ তুলেছে, বৃহত্তর মুক্তিযোদ্ধা পরিবারদের নিষ্ক্রিয়তা জাতিকে হতবাক ও ব্যথিত করেছে।
এ পরিস্থিতিতে, লুটেরা একনায়ককে উৎখাত করার পরও জাতির এই দুর্দশা কাটাতে সব মুক্তিযোদ্ধাকে ঐক্যবদ্ধভাবে গণআন্দোলনের পক্ষে দাঁড়ানো এবং ছাত্র-জনতার পাশে থেকে জাতির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা পালন করা অত্যন্ত জরুরি। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, অধিকাংশ বয়োজ্যেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা এখনো দেশের সঙ্কট মোকাবেলায় তাদের সর্বশক্তি দিয়ে পাশে দাঁড়াতে প্রস্তুত।
একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং দেশের প্রবীণ নাগরিক হিসেবে আমি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কিছু লক্ষ্য এবং তা বাস্তবায়নের জন্য কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরছি:
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান লক্ষ্য:
১) আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী একটি অপরিবর্তনীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, যা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে পরিচালিত হবে।
২) বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে, সরকারের এবং অন্য কোনো অশুভ গোষ্ঠীর প্রভাবমুক্ত একটি কার্যকর বিচারব্যবস্থা গড়ে তোলা।
৩) সংবিধানে এমন পরিবর্তন আনা, যা ভবিষ্যতে কোনো স্বৈরাচারী শাসককে ফ্যাসিবাদী শাসন প্রতিষ্ঠার সুযোগ দেবে না।
৪) পারস্পরিক সম্মান ও সমতার ভিত্তিতে দীর্ঘমেয়াদি পররাষ্ট্রনীতি তৈরি করা, যা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সুরক্ষিত রাখবে।
বাস্তবায়নের প্রস্তাবিত পদক্ষেপ:
১) নির্বাচন সংস্কার করে একটি গণবান্ধব ও সুষ্ঠু নির্বাচনি রোডম্যাপ তৈরি করা।
২) দুর্নীতি, অর্থপাচার ও জাতীয় সম্পদ লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে জাতীয় প্রচারণা শুরু করা।
৩) বিচারব্যবস্থার সংস্কার করে সৎ, যোগ্য ও নিরপেক্ষ বিচারক নিয়োগ করা।
৪) মানবতাবিরোধী অপরাধীদের দ্রুত বিচার এবং কঠোর শাস্তির বিধান রাখা।
৫) শেখ হাসিনার আমলে সম্পাদিত বৈদেশিক চুক্তিগুলোর পুনর্মূল্যায়ন এবং দেশের স্বার্থের পরিপন্থি হলে তা বাতিল করা।
৬) শিক্ষাখাতে মেধার ভিত্তিতে শিক্ষক ও ছাত্র নির্বাচন করে বিশ্বমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা।
৭) দেশের স্বাধীনতা ও সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে সশস্ত্র বাহিনীকে নতুন করে ঢেলে সাজানো।
৮) ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে সব সক্ষম ব্যক্তির জন্য বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।
৯) মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সংরক্ষণ করে দল-মত নির্বিশেষে জাতির সব শ্রেণির মানুষের অবদান নথিভুক্ত করা।
মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোটা ব্যবস্থা বর্তমানে অর্থহীন। তাই এর অপপ্রয়োগ রোধে তা সম্পূর্ণরূপে বাতিল করা অপরিহার্য।