ভ্যানগাড়িতে ছুটছেন বই নিয়ে দেশ গড়ার লক্ষ্যে: বীর মুক্তিযোদ্ধা।বীর মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তারা স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়ে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীকে বিতাড়িত করার মাধ্যমে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ছিনিয়ে এনেছেন। ৩০ লাখ শহীদ ও ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমাদের এ স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে।
বীর মুক্তিযোদ্ধারা কখনও তাদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করেননি। এমনই একজন নিঃস্বার্থ মুক্তিযোদ্ধা এনছান আলী খান। অকৃত্রিম বিবেকবোধ দেশের প্রতি গভির ভালোবাসার টানে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেন।
মুক্তিযুদ্ধা এনছান আলী খান ১৯৩৬ সনে বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার রঙ্গশ্রী ইউনিয়নের বিহারি পুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আব্দুল গনি খান ছিলেন একজন কৃষক। ৬ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে ইনছান আলী খান ৪র্থ সন্তান। বাবার অভাবী সংসারে অতি কষ্ট করে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত কাফিলা হাই স্কুলে লেখাপড়া করেন তিনি। ১৯৭১ এর রণাঙ্গনে ৩৫ বছরের আত্মত্যাগ মুক্তিকামী সৈনিক ২ নম্বর সেক্টরে ক্যাপ্টেন হায়দার আলীর নেতৃত্বে সোনারগাঁও, কাচপুর, মুরাপাড়া,আদমজী জুটমিল সংলগ্ন এলাকায় দায়িত্ব পালন করেছেন। ঢাকা সারদা পুলিশ লাইনে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিয়ে দেশরক্ষায় জীবনকে তুচ্ছ করে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। যুদ্ধের মাঠে লড়াই এর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, আহার-নিদ্রা কি জিনিস ভুলেই গেছিলাম। চোখের জলে বলেন স্বপ্ন একটাই ছিল মাতৃভূমি মানেই মা জীবন দিয়ে হলেও তাকে বাঁচাতে হবে। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে অসংখ্যবার মৃত্যুর দুয়ারে গিয়েও যুদ্ধ করে বেঁচে রয়েছি। এখনো মনে পড়লে ঘুম আসে না। কাঁচপুর ব্রিজের উপর পাকিস্তানি মিলিটারির সাথে অনেকক্ষণ গোলাগুলি হয় চারপাশ দিয়ে আমাকে ঘিরে রাখে অস্ত্র কাঁধে নিয়ে বাধ্য হয়ে ঝাঁপ দেই নদীতে। অসংখ্য মৃতদেহ ভাসতে থাকে নদীতে একটি মৃতদেহ জড়িয়ে ধরে নদীর কিনারায় গিয়ে উঠি। যুদ্ধশেষে স্বাধীনতা লাভের পরে অর্ধাহারে-অনাহারে কেটেছে কয়েক যুগ। বর্তমানে বই বিক্রেতার পেশাকে পাথেয় করে এক সন্তানের পিতা দরিদ্রতার সাথে সংসার চালনা করছেন। আজ জীবনের এই ক্রান্তিলগ্নে ৮৬ বছর বয়সেও স্বপ্ন দেখে আগামী দিনগুলোর।মুক্তিযোদ্ধা ইনছান আলী খান বলেন, বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনমান উন্নয়নে নানাবিধ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। তাদের জন্য বাসস্থান,চিকিৎসাসেবা, কোটাভিত্তিক সরকারি চাকরিতে নিয়োগ এবং তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আশা করি এ সুযোগ-সুবিধা পর্যায়ক্রমে বাড়ানো হবে।
তিনি আরও বলেন, ‘আমি ৩০০ টাকা থেকে শুরু করে এখন ২০ হাজার টাকা সম্মানী ভাতা পাইতেছি। আলহামদুলিল্লাহ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। সম্মানীভাতা দিয়ে আমার সংসার চলে যায়। গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে ভ্যান গাড়িতে বই বিক্রি করি মানুষের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও ইসলামী শিক্ষার দিনের আলো ছড়িয়ে দেয়ার জন্য’।তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে কাজ করছেন। আমি একজন রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানাই প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটিতে একজন মুক্তিযোদ্ধা রাখার জন্য। এতে করে শিক্ষা খাতে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পৃক্ততা বাড়বে। মুক্তিযোদ্ধারা যেমন জীবন বাজি রেখে দেশ স্বাধীন করেছেন, তেমনি তারা শিক্ষা খাতেও শ্রম ও মেধা দিয়ে দেশের শিক্ষা কার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে পারবেন।’তিনি আরো বলেন, ‘ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে পারে সেজন্য আমি বাকেরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের পল্লীর পাড়ায় পাড়ায় ঘুড়ে ঘুড়ে ভ্যান গাড়িতে করে বর্তমান প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে বিনা লাভে স্বাধীনতার ইতিহাস,বঙ্গবন্ধুর জীবনি সহ বিভিন্ন রকমের বই বিক্রি করতেছি। এতে করে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে পারবে। কিভাবে রাজাকার, আল-বদররা দেশে গণহত্যা-অগ্নিসংযোগ করেছে, তাও সঠিকভাবে জানতে পারবে। কাদের অবদানে আমরা এই স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি, আশা করি সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ সম্মানের স্থানে রাখবে। স্বাধীনতার সম্মান রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সকলের। যেখানে বাংলার মানুষ আরো সংগঠিত হয়ে দাঁড়াবে বঞ্চিত মানুষের পাশে। বিকশিত হবে স্বাধীনতার স্বাদ সার্থক হবে আত্মত্যাগ।’
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু তখন চেষ্টা করেছেন দেশটাকে দাঁড় করাতে। কিন্তু বড় বড় নেতা ও অনেক মুক্তিযোদ্ধারাও কিন্তু তাঁর পাশে ছিলেন না। তাঁরা শুধু নিজের স্বার্থ আর তেল মারাতেই ব্যস্ত ছিলেন। আমি মনে করি, দেশের জন্য একজন মুক্তিযোদ্ধার লড়াইটাও সারা জীবনের। আমি এখনো ৮৬ বছর বয়সে ভ্যান গাড়িতে করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, বঙ্গবন্ধুর জীবনী, ছেপারা, অজিফা, কুরআন শরীফ, নামাজ শিক্ষার বই সহ গজল এর বই মোকসেদুল মোমিন এর বই সহ বিশ্ব নবীর জীবনী, বড় পীরের জীবনী, কবরের জীবন বিভিন্ন হাদিসের বই মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতেই নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছি।’স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভালোলাগার অনুভূতি জানতে চাইলে উত্তরে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘বিভিন্ন দিবসে সারা বাংলায় যখন লাল-সবুজের পতাকা উড়ে, এ দেশের ছেলেমেয়েরা কাজের মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে যখন দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে তখন আনন্দে বুক ভরে যায়।’
কষ্ট লাগে কখন? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘যখন শুনি এমপিরা যুবকদের চাকরি দিচ্ছেন টাকার বিনিময়ে, যখন দেখি আজ এমপি তো কাল সে কোটিপতি বনে গেছেন, ছাত্র রাজনীতিতে ক্ষমতাশীল দলের ছাত্রনেতাও লক্ষ টাকার মালিক হচ্ছেন, তখন সত্যি খুব কষ্ট লাগে। দেশ ও মানুষকে বেঁচে টাকা কামানোর জন্য তো দেশটা স্বাধীন হয়নি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে দেশের ইতিহাস যেমন দায়মুক্ত হয়েছে ঠিক তেমনি সব সমস্যা পেছনে ফেলে একদিন নতুন প্রজন্মের হাত ধরেই দেশটা সত্যিকারের সোনার বাংলা হবে এমন স্বপ্নে বিভোর হন মুক্তিযোদ্ধা এনছান আলী খান।’