সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিএনএন–নিউজ এইটিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তার সরকারের পতনের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ভূমিকা ছিল না। এদিকে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনারের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, জুলাই–আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে এক হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছিলেন। নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে নিহতের সংখ্যা বেশি ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। একই সময় বিবিসি একটি অডিও ফাঁসের তথ্য প্রকাশ করে, যেখানে অভিযোগ রয়েছে—বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী শক্তি ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশে সদ্যঘটিত সরকার পরিবর্তন ও রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে যখন আন্তর্জাতিক মহলে নানা আলোচনা চলছে, ঠিক তখনই সিএনএন–নিউজ এইটিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দাবি করেছেন—তার সরকারের পতনে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোতে ওয়াশিংটনের ভূমিকা নিয়ে যে জল্পনা-কল্পনা দেখা দিয়েছে, তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, “সরকার পতনের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো হাত নেই। পরিস্থিতি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ছিল।” তিনি আরও জানান, দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিরতা, আন্দোলন এবং প্রশাসনিক চাপ তাকে দেশত্যাগে বাধ্য করেছিল। তার বক্তব্য আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
আরও পড়ুন আগামী নির্বাচনে বিরোধী শিবিরে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য ভূমিকা: বিশ্লেষণ
এদিকে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনারের (ওএইচসিএইচআর) সদ্য প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত জুলাই–আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের সময় এক হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছিলেন। এসব মৃত্যুর বড় অংশই নিরাপত্তা বাহিনীর সামরিক অস্ত্র ও শটগানের গুলিতে ঘটে। প্রতিবেদনটিতে দাবি করা হয়েছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে নিরাপত্তা বাহিনী অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করেছিল।
অন্যদিকে, বিবিসির অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে একটি ফাঁস হওয়া অডিও রেকর্ডিং প্রকাশ করা হয়। সেখানে দাবি করা হয়েছে—বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী শক্তি প্রয়োগের অনুমতি দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যদিও তিনি এই অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছেন। তার মতে, অডিও রেকর্ডিংটি মনগড়া ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
বিবিসির তদন্ত অনুযায়ী, দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়া আন্দোলনের সময় নিরাপত্তা বাহিনীকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। আন্দোলন দমন করতে শটগান, রাবার বুলেট ও সামরিক অস্ত্র ব্যবহারের ঘটনাও সেখানে উঠে এসেছে। এতে নাগরিক সমাজ, মানবাধিকার সংগঠন ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, রাজনৈতিক নির্দেশনার কারণে ওই সময়ে সহিংসতা বেড়ে গিয়েছিল এবং অনেকে প্রাণ হারিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন রহস্যময় নীল ড্রাম খুন: ৩ দিন আগে বন্ধুর সঙ্গে ঢাকায় এসে নিখোঁজ, পরে মিলল ২৬ টুকরা মরদেহ
বিশ্লেষকদের মতে, শেখ হাসিনার ‘‘যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ভূমিকা নেই’’ মন্তব্য দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার কৌশল। কারণ সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো ধারাবাহিকভাবে বক্তব্য দিয়েছে এবং গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ইস্যুতে নজরদারিতে রেখেছে।
এদিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও রাজনৈতিক উত্তেজনা এখনও পুরোপুরি প্রশমিত হয়নি। নতুন সরকারের অধীনে বিচার, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং আন্দোলনে নিহতদের বিষয়ে তদন্তের দাবি আরও জোরালো হচ্ছে। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ তদন্ত ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন ও ফাঁস হওয়া অডিওর কারণে শেখ হাসিনার অবস্থান আরও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। একইসঙ্গে নিজের বক্তব্যে যুক্তরাষ্ট্রকে দায়মুক্ত ঘোষণা করে তিনি হয়তো পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে কূটনৈতিক বার্তা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
সর্বশেষ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু—জুলাই–আগস্টের সহিংসতা, নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকা, এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ক্ষমতাসীনদের নির্দেশনার প্রভাব। এসব বিষয় নিয়ে বাংলাদেশে এখনো নানা পর্যায়ের তদন্ত চলছে, যা ভবিষ্যতে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বড় পরিবর্তন আনতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
.png)