রাজধানীর জাতীয় ঈদগাহের সামনের সড়ক থেকে দুটি নীল ড্রামে ২৬ টুকরা অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে কাঁচামাল ব্যবসায়ী আশরাফুল হকের মরদেহ। তিন দিন আগে অসুস্থ বাবাকে হাসপাতালে রেখে তিনি প্রবাসী বন্ধু জরেজ মিয়ার সঙ্গে ঢাকায় আসেন। এরপর তার ফোন বন্ধ থাকলেও জরেজ মিয়া আশরাফুলের ফোন ব্যবহার করছিলেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় পুলিশ নীল ড্রাম থেকে মরদেহ উদ্ধার করে এবং সিআইডি ফিঙ্গারপ্রিন্টের মাধ্যমে তার পরিচয় শনাক্ত করে। হত্যার কারণ বা পদ্ধতি এখনও স্পষ্ট নয়। তবে জরেজ মিয়া বর্তমানে পলাতক। পুলিশ ধারণা করছে, দু-একদিন আগেই তাকে খুন করা হয়েছে।
রাজধানী ঢাকার ব্যস্ততম সড়কের একটি সাধারণ সন্ধ্যা হঠাৎই পরিণত হয় ভয়াবহ আতঙ্কের ঘটনায়। বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) হাইকোর্ট সংলগ্ন জাতীয় ঈদগাহ মাঠের সামনের রাস্তা থেকে উদ্ধার করা হয় দুটি নীল রঙের ড্রাম। ড্রামের ভেতরে থাকা দৃশ্যটি দেখে আঁতকে ওঠে স্থানীয়রা—একজন মানুষের ২৬ টুকরা খণ্ডিত মরদেহ নিথরভাবে পড়ে আছে সেখানে।
পরে ফিঙ্গারপ্রিন্ট বিশ্লেষণের মাধ্যমে মরদেহটি শনাক্ত করে সিআইডি। নিহত ব্যক্তির নাম আশরাফুল হক (৪৩)—রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার শ্যামপুরের গোপালপুর নয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। পেশায় তিনি ছিলেন একজন কাঁচামাল ব্যবসায়ী, যিনি দীর্ঘদিন ধরে হিলি সীমান্ত এলাকা থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাইকারি বিক্রি করতেন।
বন্ধুর সঙ্গে ঢাকায় আসা, এরপর নিখোঁজ—শুরু হয় হত্যাকাণ্ডের রহস্যগাথা
ঘটনার তিন দিন আগে আশরাফুল তার অসুস্থ বাবাকে রংপুরের হাসপাতালে রেখে ঢাকায় আসেন প্রবাসী বন্ধু জরেজ মিয়ার (৪১) সঙ্গে দেখা করতে। তাদের মধ্যে দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব ছিল। কিন্তু ঢাকা আসার পর থেকেই কিছুটা অস্বাভাবিক মনে হয় আশরাফুলের স্ত্রী লাকীর কাছে।
স্ত্রী জানান—
“আমি ফোন করলে আমার স্বামীর ফোন ধরে জরেজ। সে বলত, ভাই ব্যস্ত আছে, পরে কথা বলবে। কিন্তু আমি কথা বলতে চাইলে সে এড়িয়ে যেত।”
এই আচরণই পুলিশকে সন্দেহের কেন্দ্রে নিয়ে যায় জরেজ মিয়ার দিকে, যিনি এখন পর্যন্ত পলাতক।
কীভাবে ঘটল ভয়াবহ এই হত্যাকাণ্ড? পুলিশের সন্দেহ—আগেই পরিকল্পনা করা হয়েছিল
পুলিশের ধারণা, হত্যাকাণ্ডটি দু–একদিন আগেই সংঘটিত হয়েছে। কারণ, মরদেহের অবস্থা দেখে তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে হত্যার পর টুকরো করে নেওয়া হয়েছে এবং পরিকল্পিতভাবে ড্রামে ভরে রাখা হয়েছে।
ক্রাইম সিন ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে প্রাথমিক বিশ্লেষণে জানতে পারে:
-
মরদেহ অত্যন্ত নিখুঁতভাবে খণ্ডিত
-
ড্রামের ভেতরে বিশেষ রাসায়নিকের গন্ধ পাওয়া গেছে
-
ঘটনাস্থলে রক্তের কোনো চিহ্ন নেই, অর্থাৎ অন্য কোথাও হত্যা করা হয়েছে
-
পরিকল্পিতভাবে লাশ ফেলা হয়েছে যাতে দ্রুত শনাক্ত করা না যায়
এটি সাধারণ কোনো হত্যাকাণ্ড নয়, বরং সুস্পষ্টভাবে একটি পরিকল্পিত ও পেশাদার কায়দার হত্যাকাণ্ড।
আরও পড়ুন তালাকপ্রাপ্ত নারী কিভাবে পেলেন মুক্তিযোদ্ধার ভাতা
বন্ধুত্বের আড়ালে প্রতারণা নাকি ব্যবসায়িক বিরোধ? খতিয়ে দেখছে পুলিশ
পুলিশ এখন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তদন্ত করছে। এর মধ্যে কয়েকটি সম্ভাব্য কারণ সামনে এসেছে:
১️⃣ ব্যবসায়িক লেনদেনের বিরোধ
আশরাফুল বড় পরিমাণ কাঁচামাল ব্যবসা করতেন। অতীতে কয়েকজনের সঙ্গে টাকার লেনদেন নিয়ে সমস্যা হয়েছিল। পুলিশ খতিয়ে দেখছে—জরেজ মিয়ার সঙ্গে কি তার কোনো ব্যবসায়িক মতবিরোধ ছিল?
২️⃣ বিদেশে প্রবাসী বন্ধু হিসেবে পরিচিত জরেজ—তার অতীতও খতিয়ে দেখা হচ্ছে
জরেজ মিয়া প্রবাসে থাকলেও তার নামে কিছু অসংগঠিত কর্মকাণ্ডের তথ্য পুলিশের কাছে এসেছে। তিনি দেশের বাইরে থেকে টাকা লেনদেন করতেন।
৩️⃣ ফোন নিজের কাছে রেখে প্রতারণা—স্পষ্ট সন্দেহের ইঙ্গিত
ঘটনার পর থেকে আশরাফুলের ফোন ব্যবহার করছেন জরেজ। এটি পুলিশের কাছে সবচেয়ে বড় প্রমাণ যে তিনি এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত।
আশরাফুলের পরিবার শোকে ভেঙে পড়েছে—বিচারের দাবি রংপুরবাসীর
রংপুরে আশরাফুলের গ্রামের বাড়িতে চলছে কান্না ও মাতম। গ্রামবাসীরা বলছেন—
“আশরাফুল কারও সাথে শত্রুতা করতেন না। তাকে এভাবে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো কেন?”
তার পরিবার দ্রুততম সময়ে হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও বিচার দাবি করেছে।
পুলিশের পরবর্তী তদন্ত—জরেজকে ধরতে বিশেষ টিম কাজ করছে
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) জানিয়েছে, জরেজ মিয়াকে ধরতে একাধিক গোয়েন্দা ইউনিট কাজ করছে। তার শেষ অবস্থান শনাক্ত করতে ফোন ট্র্যাকিং এবং সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হচ্ছে।
এছাড়া আশরাফুলের ব্যবসায়িক সংযোগ, ব্যাংক হিসাব, মোবাইল কললিস্ট বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।
পুলিশ বলেছে:
“এটি খুবই নৃশংস হত্যাকাণ্ড। হত্যাকারী যতই পরিকল্পিত হোক, আইনের হাত থেকে রক্ষা পাবে না।”
আরও পড়ুন জুলাই সনদের পথে এগোচ্ছে এনসিপি
ঘটনাটি ঢাকার ইতিহাসে নতুন আরেকটি ভয়াবহ নৃশংসতার চিত্র
নীল ড্রামে খণ্ডিত লাশ উদ্ধার—এই দৃশ্যটি ইতোমধ্যেই সমাজে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। মানুষের মনে প্রশ্ন—বন্ধুত্বের আড়ালে কীভাবে এমন নির্মমতা লুকিয়ে থাকতে পারে?
এই হত্যাকাণ্ড কেবল একটি ঘটনা নয়, বরং সমাজের ভেতরে বেড়ে ওঠা অপরাধচক্রের ভয়াল ইঙ্গিত।
এখন সবার নজর পুলিশি তদন্তে—জরেজ মিয়াকে দ্রুত গ্রেপ্তার করে প্রকৃত রহস্য উন্মোচন করা না গেলে দেশজুড়ে আতঙ্ক আরও বাড়তে পারে।
.png)