যে বয়সে বাড়িতে নাতি-নাতনিদের সঙ্গে অবসর সময় কাটানোর কথা, সেই বয়সে তিনি কিনা জীবনের সব আরাম–আয়েশ বিসর্জন দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন খেলাধুলার এক নীরব সাধক হিসেবে। যশ-খ্যাতির পেছনে কখনো দৌড়াননি। জীবন সংসারে কী পেলেন আর কী পেলেন না,
১৯৪২ সালের ১ জানুয়ারি তাঁর জন্ম পিরোজপুর জেলার ভান্ডারিয়া থানার দক্ষিণ ভান্ডারিয়া গ্রামে। তার মানে ৮০ বছর পেরিয়েছেন মাস তিনেক আগে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা মজিবুর রহমানের জীবনে অবসর বলে কিছু নেই। স্বাধীনতার আগে পূর্ব পাকিস্তানে ভারোত্তোলন করেছেন
নিজে খেলা ছাড়ার পর নেমেছেন তৃণমূল থেকে নবীন ভারোত্তোলক তুলে আনার কাজে। বাংলাদেশ আনসারের নারী ভারোত্তোলন দলের কোচের দায়িত্বে আছেন ২০০১ সাল থেকে। এর বাইরেও নতুন প্রতিভা খুঁজে বের করাটাই তাঁর নেশা। বলতে গেলে ভারোত্তোলন নিয়েই তাঁর জীবন।
বাংলাদেশের ভারোত্তোলন প্রসঙ্গ এলেই মজিবুর রহমানের কথা আসে। সবাই সম্মানের সঙ্গে নামটি উচ্চারণ করেন। বাংলাদেশ ভারোত্তোলন ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান সহসভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ মজিবুরের অবদানের কথা বলেন মুগ্ধতার সঙ্গে, ‘১৯৬৫ সালে আমার ভারোত্তোলন জীবনের শুরু থেকেই তাঁকে পেয়েছি। সেই থেকে আজও আছেন ভারোত্তোলনের সঙ্গে। খেলাধুলা তাঁর নেশা। জাতীয় পর্যায়ে নামীদামি অনেক খেলোয়াড় তৈরি করেছেন। এমন খেলাপাগল মানুষ বিরল। তার ওপর তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।
এই মজিবুর রহমানই পরম মমতায় নিজের ‘ভারোত্তোলন-সংসার’ পেতেছেন ঢাকার অদূরে গাজীপুরের টঙ্গীর এরশাদ নগরে। স্থানীয় আদর্শ ছাত্র কল্যাণ সমিতির মার্কেটের ৪ নম্বর পুকুর পাড়ে ভাড়া জায়গায় গড়ে তুলেছেন ‘এরশাদ নগর ভারোত্তোলন ও শরীরচর্চা ক্লাব’। এই সংসারের তিনিই কর্তা। তিনিই সব।
গত ১০ ফেব্রুয়ারি রাত আটটায় সেই ভারোত্তোলন ও শরীরচর্চা কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেল, জীর্ণ দুটি ঘরে ম্লান আলোতে অনুশীলন করছে ছেলেমেয়ে মিলিয়ে ১০-১২ জন ভারোত্তোলক। পুকুর পাড়ে বলে স্যাঁতসেঁতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। সঙ্গে মশার উপদ্রব। বৃষ্টির সময় নাকি খুব বেশি সমস্যা হয়। জায়গাটা নিচু হওয়ায় হাঁটুপানি ঢুকে পড়ে জিমনেসিয়ামে। অনুশীলন বন্ধ থাকে তখন। ঘরের টিনের চাল ফুটো হয়ে যাওয়ায় পানি পড়ে ওপর থেকেও, যা ঠেকাতে আপাতত নিজের টাকায় একটা ত্রিপল লাগিয়ে নিয়েছেন মজিবুর।
১৯ মার্চ শনিবার বিকেল ৪টায় আবার সেই জিমনেসিয়ামে গিয়েও একই দৃশ্য। শিষ্যদের নিয়ে অনুশীলনে মগ্ন মজিবুর। দিনেও মশার উপদ্রব। কিন্তু স্থানীয় ছেলেমেয়েরা এসব সমস্যা হাসিমুখে মেনে নেয়। ১২ বছরের শিশু প্রশিক্ষণার্থী থেকে ২৫ বছরের ছেলেমেয়েও আছে মজিবুরের ভারোত্তোলন পাঠশালায়। পিঠের ওপর মজিবুর রহমানের ভালোবাসার হাত পেয়ে এলাকার সব মিলিয়ে ২৫-৩০ জন ছেলেমেয়ে এখন সেখানে ভারোত্তোলন শিখছে একাগ্রতার সঙ্গে।
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বয়সের দূরত্ব ঘুচিয়ে অনায়াসে মিশে যান মজিবুর রহমান। দেখে মনেই হয় না তাঁর বয়স আশির চৌকাঠ পেরিয়েছে। নিয়মিত শরীরচর্চা করায় ফিটনেস ভালো। প্রচণ্ড উদ্যমী মানুষ। সেই উদ্যম থেকেই ভবিষ্যতের ভারোত্তোলন প্রজন্ম তৈরির সংকল্প নিয়েছেন। ১৯৮৮ সালে ওই এলাকায় তিনি ভাইবন্ধু নামে প্রথম ভারোত্তোলন ক্লাব করেছিলেন। এরশাদ নগরে এই ভারোত্তোলন ও শরীরচর্চা ক্লাবটির জন্ম ২০০৫ সালে।
অনেক কষ্ট সয়ে ৩৫ বছর ধরে ছেলেমেয়েদের ভারোত্তোলন শিখিয়ে চলেছেন মজিবুর রহমান। সম্প্রতি ঢাকায় বাংলাদেশের ভারোত্তোলন পরিবার তাঁর আশিতম জন্মবার্ষিকী পালন করেছে, এরশাদ নগর জিমনেসিয়ামের দেয়ালের গায়ে টাঙানো সেই ছবি আলাদাভাবে চোখ কাড়ে। খেলোয়াড়, কোচ, সংগঠক...সব ভূমিকায় তাঁর ছবি ঝুলছে দেয়ালে। তারই একটা ছবি দেখিয়ে বলেন, ‘এই যে...এই ছবিতে ২০২৬ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আনসার সেবা পদক পরিয়ে দিচ্ছেন আমাকে। ভারোত্তোলন কোচ এবং সেরা সংগঠক হিসেবে এই পদক পেয়েছি।’
প্রয়াত চলচ্চিত্র নায়ক ওয়াসিমের সঙ্গে নিজের একটা ছবি দেখান। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ বডিবিল্ডিং ফেডারেশন মজিবুরকে মুক্তিযোদ্ধা স্মারক দেয়, সেখানেই উপস্থিত ছিলেন বডিবিল্ডিং ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ওয়াসিম। যিনি নিজেও ছিলেন বডিবিল্ডার। দেয়ালের গায়ে টানানো এই ছবিগুলো অনুচ্চারে পরিচয় করিয়ে দেয় মুক্তিযোদ্ধা মজিবুর রহমানকে।