বীর মুক্তিযোদ্ধাকে মারধর
![]() |
বীর মুক্তিযোদ্ধাকে মারধর |
রাজধানীর হাজারীবাগের একটি মসজিদে ফজলুল হক নামে এক বীর মুক্তিযোদ্ধাকে ইফতারের সময় স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের একজন নেতা মারধর করেছেন। মসজিদের মুসল্লিদের সামনে গায়ে হাত তোলায় ওই মুক্তিযোদ্ধা লজ্জায় বাসা থেকেই বের হন না। গত ১৫ দিন ধরে তিনি বেশিরভাগ সময় বাসায় থাকেন। এই ঘটনায় হাজারীবাগ থানায় তিনি একটি অভিযোগ দিলেও পুলিশ সেটিকে মামলা হিসেবে নেয়নি।
গত ১৬ এপ্রিল সন্ধ্যায় পুরান ঢাকার হাজারীবাগ থানা এলাকার নীলাম্বর সাহা রোডস্থ বাইতুর রহমান জামে মসজিদ কমিটির আমন্ত্রণে দোয়া ও ইফতার মাহফিল হয়। মসজিদ কমিটির সদস্য হিসেবে সেখানে উপস্থিত ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হকও। মসজিদে প্রবেশের সময় তিনি দরজা খুলে রাখেন। এ নিয়ে তার সঙ্গে মসজিদে তর্কে জড়ান স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম সম্পাদক দুলাল হোসেন। তাকে মুসল্লিদের সামনেই ধাক্কা ও ঘুষি দেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, 'আমি দরজা খুলে রেখেছি কেন, এজন্য আমাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। সবার সামনেই আমার গায়ে হাত তোলে দুলাল। এরপর থেকে আমি লজ্জায় বাইরে বের হই না।'
এই বীর মুক্তিযোদ্ধা গত দুসপ্তাহ ধরে স্বেচ্ছায় গৃহবন্দি। ঈদে সন্তানদের জন্য কেনাকাটায় মার্কেটেও যাননি। বর্তমানে তিনি তার এনায়েতগঞ্জের বাসায় রয়েছেন।
ঘটনার সময় মসজিদ কমিটির সভাপতি ও হাজারীবাগ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাদেক হামিদ সাজুও উপস্থিত ছিলেন। দুলাল হোসেন তার অনুসারী এবং ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। তার সামনেই দুলাল ফজলুল হককে মারধর করে। তিনিও এর প্রতিবাদ করেননি।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হকের সঙ্গে সাদেক হামিদ সাজুর দ্বন্দ্ব রয়েছে বলে এলাকাবাসী জানিয়েছে। হাজারীবাগের এনায়েতগঞ্জে দুজনের বাসা পাশাপাশি হলেও তাদের দুজনের মধ্যে রেষারেষি রয়েছে। সাদেক হামিদ সাজুও মুক্তিযোদ্ধা। তবে ফজলুল হক তাদের মুক্তিযোদ্ধা মানতে রাজি নন। ফজলুল হক জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে সাজুসহ ওই এলাকার ২৯ জন মুক্তিযোদ্ধার নাম উল্লেখ করে একটি অভিযোগ দিয়েছেন। অভিযোগ তিনি বলেছেন, 'সাজুসহ ২৯ জনের কেউ মুক্তিযোদ্ধা না।' এনিয়ে দুজনের দ্বন্দ্বের শুরু।
মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে অভিযোগ দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন ফজলুল হক নিজেও। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, 'তারা কোথায় মুক্তিযোদ্ধা করেছে বলুক। আমি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছে। এটা জেলা প্রশাসক তদন্ত করছেন। কজনেরটা প্রমাণও পেয়েছেন। এখনও তদন্ত শেষ হয়নি। দেখা যাক কী হয়।'
ফজলুল হক বলেন, 'আমি মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে অভিযোগ দেওয়ায় সাজু আমার ওপর ক্ষেপে আছে। তাই লোকজন দিয়ে আমাকে মারধর করিয়েছে।তবে অভিযোগের কথা অস্বীকার করেছেন হাজারীবাগ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাদেক হালিম সাজু। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, 'এলাকার মানুষের সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করে ফজলুল হক। এমনকি আমার পেছনেও গালিগালাজ করে। তবে সামনে এলে আবার ঠিক। আমি মানুষের কাছে শুনি। ঘটনার দিন মসজিদের একজন সহ সভাপতির সম্মানে ইফতারের আয়োজন করা হয়েছিল। তিনি ওমরাহ পালন করতে সৌদি যাবেন। ইফতারের ঠিক আগমুর্হর্তে আমরা মোনাজাত ধরছিলাম। হঠাৎ মসজিদের ভেতরে ঝগড়া শুনতে পাই। এরপর দুজনকেই মুসল্লিরা থামিয়ে দেন। তবে এর আগেই দুলাল নাকি ফজলুলকে ধাক্কা দিয়েছে। আমি এজন্য দুলালকে বকেছিও। পরের দিন দুলালকে ফজলুল হকের বাসায় নিয়ে মাফ চাইয়ে নিয়ে আসছি। তখন সে মাফ করে দিয়েছে।'
ঘটনার পরদিনই ফজলুল হক হাজারীবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোক্তার হোসেনের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ নিয়ে যান। ওসি অভিযোগের কাগজটিতে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তার অধীনস্থ কর্মকর্তাদের ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন। ঘটনাস্থলে পুলিশ আসেও। তবে তার অভিযোগটি মামলা বা জিডি হিসেবে নেয়নি পুলিশ।
ফজলুল হক বলেন, ঘর থেকে দু পা ফেললেই মসজিদ। নামাজ আদায়ে মসজিদেও যেতে পারছি না লজ্জায়। জরুরি প্রয়োজনে মুখ ঢেকে বাড়ি থেকে বের হলেও পরিচিতজনদের নানান প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। যারা আমাকে লাঞ্ছিত করেছে তাদের বয়স আমার ছেলের চেয়েও কম হবে। পুলিশ তদন্ত করতে এসেও ঘটনার সত্যতা পেয়েও রহস্যজনক কারণে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
ফজলুল হকের গায়ে হাত তোলার কথা স্বীকার করেছে দুলাল নিজেও। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, মসজিদের দরজা খুলে রাখলে এসি চলাকালীন ঠান্ডা হয় না। তাকে দরজা বন্ধ করতে বললে সে উল্টো আমাকে গালিগালাজ করে। তার মুখের ভাষা ভালো না। এরপর তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে তাকে একটা ধাক্কা দেই। এজন্য আমি মাফও চেয়েছি।
মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হক থানা পুলিশের কাছে অভিযোগ দিলেও পরবর্তীতে হাজারীবাগ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাদেক হালিম সাজু ওই থানার ওসিকে ফোন দিয়ে জানান বিষয়টি মীমাংসা হয়ে গেছে। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমি ওসিকে ফোন দিয়ে বলেছি, বিষয়টা মিটমাট হয়েছে। এখন আর কোনও ঝামেলা নেই। তাছাড়া ফজলুল হককে এলাকার কেউ ভালো জানে না।
বীর মুক্তিযোদ্ধার অভিযোগের বিষয়ে থানা কোনও ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে হাজারীবাগ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মাসুদুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, তিনি থানায় এসেছিলেন। ওসি স্যারের সঙ্গে কথা বলেছেন। এরপর কি হয়েছে, আমি তা বলতে পারবো না।