মুক্তিযোদ্ধা চাচার পিতৃত্বে কোটায় সরকারি চাকরি।
ময়মনসিংহে জাতীয় পরিচয়পত্রে চাচাকে বাবা ও চাচীকে মা বানিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় সরকারি চাকরি করছেন ও তাদের সম্পতি দখল করার চেষ্টা করছেন একেএম সারোয়ার (প্রকৃত নাম হোসেন শহিদ সারোয়ার) নামের এক ব্যক্তি।
সারোয়ার সদর উপজেলার ৫নং সিরতা ইউনিয়নের চর ভবানীপুর গ্রামের মৃত গিয়াস উদ্দিন ও মৃত নূর জাহান বেগম দম্পতির কনিষ্ঠ ছেলে। তবে বর্তমানে একেএম সারোয়ার তার বাবার নাম একেএম আমান উদ্দিন ও মাতার নাম মোমেনা খাতুন দাবি করে আসছেন, কিন্তু তারা সম্পর্কে তার চাচা-চাচি। একেএম আমান উদ্দিন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও স্কুল শিক্ষক ছিলেন। গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের পর ভয়ে ১৯ আগস্ট কৌশলে বদলি হয়ে একেএম সারোয়ার বিআরটিএ ঢাকা মেট্রো- ১ সার্কেলে অফিস সহায়ক হিসেবে কর্মরত আছেন।দীর্ঘ অনুসন্ধান ও প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সারোয়ার সরকারি চাকরির আশায় সদর উপজেলার চর ভবানীপুর গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা একেএম আমান উদ্দিনকে বাবা ও তার স্ত্রী মোমেনা খাতুনকে মা বানানোর কৌশল নেন। অথচ তার জন্ম নিবন্ধনে বাবার নাম মৃত গিয়াস উদ্দিন ও মাতার নাম মৃত নুরজাহান বেগম উল্লেখ রয়েছে। এরপর জাতীয় পরিচয়পত্রে বাবা মৃত গিয়াস উদ্দিনের জায়গায় চাচা বীর মুক্তিযোদ্ধা একেএম আমান উদ্দিনের নাম বসান এবং মাতা নুরজাহান বেগমের জায়গায় মোমেনা খাতুন বসান। এছাড়াও তার জন্ম নিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্রে পাওয়া গেছে বয়সের গড়মিল।
এদিকে একেএম আমান উদ্দিন ২০০৫ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি মারা গেলে কৌশলে ২০০৭ সালে জালিয়াতি করে জাতীয় পরিচয়পত্রে আমান উদ্দিনের নাম বসান সারোয়ার। আমান উদ্দিনের ছেলে সেজে ২০১৩ সালের দিকে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ময়মনসিংহ বিআরটিএ কার্যালয়ে অফিস সহায়ক পদে চাকরি নেন। শুধু তাই নয়, বীর মুক্তিযোদ্ধা নিঃসন্তান থাকায় এবং তার স্ত্রী মোমেনা খাতুন ২০২১ সালের ১৬ নভেম্বর মারা যাওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধার ওয়ারিশান হিসেবে দীর্ঘ ৩৫ মাস যাবত মাসিক ২০ হাজার টাকা ভাতা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করে আসছে এবং তাদের সম্পত্তি দখল করে বসেছে এই প্রতারক সারোয়ার।
৫নং সিরতা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, মোঃ হোসেন শহিদ সারোয়ারের জন্মদাতা পিতা মৃত গিয়াস উদ্দিন ও মাতা মৃত নুর জাহান এবং তার সহোদর বড়ভাই সালাউদ্দিন।
একই ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোঃ আজিজুল ইসলামের স্বাক্ষরিত এক প্রত্যয়নপত্র থেকে জানা গেছে, সারোয়ারের চাচা মৃত বীর মুক্তিযোদ্ধা একেএম আমান উদ্দিন সিরতা ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের একজন স্থায়ী বাসিন্দা এবং নিঃসন্তান থাকা অবস্থায় ২০০৫ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি মারা গেছেন।ও্ই চেয়ারম্যানের স্বাক্ষরিত আরেক প্রত্যয়নপত্র থেকে জানা গেছে, সারোয়ারের আসল পিতা গিয়াস উদ্দিন ও মাতা নুর জাহান। গিয়াস উদ্দিন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না এবং মুক্তিযোদ্ধা একেএম আমান উদ্দিন তার পিতা নয়। তিনি মারা যাওয়ার আগে শাহিন মিয়া নামে একটি ছেলেকে লালন-পালন করছিলেন।
সারোয়ারের সহোদর বড়ভাই সালাউদ্দিন বলেন, সারোয়ার আমার আপন ছোটভাই। আমার চাচা-চাচি ছোটবেলায় সারোয়ারকে পালক নিয়েছিল। কিন্তু সারোয়ার তাদের ঔরসজাত সন্তান নয়। তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, এখন সেটা আইন বুঝবে, কি হবে তার।
অন্যদিকে সারোয়ারের বড়ভাই সালাউদ্দিনের বক্তব্যকে মিথ্যা দাবি করে চাচাতো ভাই শাহ আলম বাদশা বলেন, আমার চাচা আমান উদ্দিন মুক্তাগাছা পদুরবাড়ি এলাকা থেকে ৭ দিন বয়সী শিশু শাহিনকে পালক নিয়ে লালন-পালন করে, সে বড় হওয়ার পর তাকে বিয়ে করিয়েছিল। বিয়ের কিছুদিন পর শাহিনকে যখন চাচা ২ কাঠা জমি লিখে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, ঠিক তখনই সারোয়ার ষড়যন্ত্র করে শাহিনকে এলাকা ছাড়া করে। আদৌওতে সারোয়ারকে চাচা লালন-পালন করেননি।
শাহ আলম বাদশার মন্তব্যকে সঠিক উল্লেখ করে সারোয়ারের দূরসম্পর্কের মামাতো ভাই মাহমুদুল হাসান বলেন, আমার ফুপা-ফুপু নিঃসন্তান থাকার সুযোগ নিয়েছে সারোয়ার। সেই সুযোগে তাদের সম্পত্তির কিছু অংশ গোপনে লিখে নিয়েছে, আর বাকি সম্পত্তি জোরপূর্বক দখল করে রেখেছে। সে বিশ্ব প্রতারক, নিজের চাচা-চাচিকে বাবা-মা বানিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কোটায় সরকারি চাকরি নিয়েছে। আমি তার এই প্রতারণা ও জালিয়াতির ঘটনায় আদালতে মামলা দায়ের করেছি এবং মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তদন্ত করে সারোয়ারের এসব জালিয়াতির সত্যতা পেয়েছে।
৫নং সিরতা ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোঃ আজিজুল ইসলাম বলেন, সারোয়ার একজন ভয়ংকর প্রতারক। আমার পার্শ্ববর্তী এক ইউপি সদস্যকে দিয়ে আমার কাছ থেকে ওয়ারিশান সার্টিফিকেট নিয়েছিল, যখন আমি বিষয়টি জানতে পারি, তখন সারোয়ারের বিরুদ্ধে কোতোয়ালি মডেল থানায় একটি জিডি করেছি। তার আসল পিতা গিয়াস উদ্দিন ও মাতা নুর জাহান।
সারোয়ারের বিরুদ্ধে মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা সিআইডির পুলিশ পরিদর্শক মোশাররফ হোসেন মিয়া বলেন, সারোয়ার অনেক চতুর প্রকৃতির লোক, সে কৌশলে চাচা-চাচিকে বাবা-মা বানিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কোটায় সরকারি চাকরি নিয়েছে। আমি তদন্তে যার সত্যতা পেয়েছি এবং আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছি।
অপরদিকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ততথ্যে জানা গেছে, একেএম আমান উদ্দিনের ওয়ারিশদের মধ্যে তালিকায় পুত্র হিসেবে একমাত্র একেএম সারোয়ারের নাম অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
ময়মনসিংহ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রব বলেন, মুক্তিযোদ্ধা একেএম আমান উদ্দিনের সাথে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল এবং তিনি সাবেক কমান্ডারও ছিলেন। তাদের দাম্পত্য জীবনে কোন সন্তান ছিল না। আর সারোয়ার চাচা-চাচিকে বাবা-মা বানিয়ে ফেলবে এটার কোন সুযোগ নেই। কারণ সে তো তাদের সন্তানই না। কোটায় সরকারি চাকরি পাওয়ার জন্য নিশ্চয়ই মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে এই জালিয়াতিটা করেছে সে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে হোসেন শহিদ সারোয়ার ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, এসব বিষয়ে মামলা হয়েছে, আদালতে মামলা চলমান আমি কোন মন্তব্য করবো না। ৫ আগস্টের পর আমি ময়মনসিংহ থেকে বদলি হয়ে ঢাকায় চাকরি করছি।
আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন চৌধুরী জানান, নিজের পিতামাতা ছাড়া অন্য কাউকে পিতামাতা বানিয়ে তথ্য গোপন করে এনআইডি কার্ড করার সুযোগ নেই। যদি কেউ তা করে থাকে, তবে তার আইডি কার্ড বাতিল হবে এবং সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।