পটুয়াখালীর দুমকীতে মুক্তিযোদ্ধা আবাসন প্রকল্পে ভয়াবহ অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগে জানা গেছে, অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের বাদ দিয়ে সচ্ছল ব্যক্তিদের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রকল্পের বরাদ্দ যাচাই-বাছাইয়ের সময় দেখা যায়, যারা প্রকৃতপক্ষে ভাঙা ঘরে বসবাস করছেন, তাদের সচ্ছল হিসেবে দেখানো হয়েছে, আর সচ্ছলদের অসচ্ছল হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। বিষয়টি মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। প্রশাসনের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে—কিছু মুক্তিযোদ্ধা ও প্রভাবশালী ব্যক্তির চাপেই এই তালিকা বদলানো হয়েছে। স্থানীয় ইউএনও জানিয়েছেন, অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত চলছে এবং দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আবাসন নিয়ে এমন অনিয়ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে একেবারেই বেমানান।
অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের সচ্ছল দেখিয়ে নাম বাদ — দুমকীতে আবাসন প্রকল্পে অনিয়ম
বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাঁদের সম্মান ও পুনর্বাসনের জন্য সরকার বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সেই মহৎ উদ্যোগেও অনিয়মের ছায়া পড়েছে। পটুয়াখালীর দুমকী উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আবাসন প্রকল্পে দেখা দিয়েছে গুরুতর স্বজনপ্রীতি ও অসচ্ছতা।
প্রকল্পের পটভূমি ও বরাদ্দ প্রক্রিয়া
২০২২ সালের ৩১ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে জেলার পাঁচ উপজেলায় ১৪৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার জন্য ঘর বরাদ্দ হয়।
দুমকীর তালিকায় ছিল ১৮ জনের নাম। প্রথম ধাপে ১২ জন ঘর পান, বাকি ৬ জন বাদ পড়েন।
তবে পরবর্তী অর্থবছরে বাদ পড়াদের অনুকূলে নতুন বরাদ্দ আসে এবং ২০২৪ সালের ১০ জুন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স তারিক ব্রাদার্সকে নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
প্রায় এক কোটি টাকার বেশি বাজেটের এই প্রকল্পে মুক্তিযোদ্ধাদের আশা ছিল—এবার অন্তত সবার মাথার উপর ছাদ উঠবে। কিন্তু ঘটল উল্টোটা।
বরাদ্দে অদ্ভুত গরমিল ও অভিযোগ
৩ অক্টোবরের চিঠিতে স্থানীয় প্রশাসনকে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত অবস্থা যাচাইয়ের নির্দেশ দেওয়া হয়।
এরপর দেখা যায়, চারজন প্রকৃত অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাকে “সচ্ছল” হিসেবে দেখানো হয়েছে।
ফলে তাঁদের ঘর নির্মাণ স্থগিত রাখা হয়।
অভিযোগ অনুযায়ী, কয়েকজন প্রভাবশালী মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় প্রভাবশালী মহল তালিকা পরিবর্তন করে নিজেদের অনুকূলে ঘর পেতে চেষ্টা করেছেন।
তারা প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে নতুন তালিকা জমা দেয়, যা বাস্তবতার সঙ্গে মিল ছিল না।
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের করুণ বাস্তবতা
যাদের সচ্ছল বলা হয়েছে, বাস্তবে তারা অমানবিক কষ্টে জীবন কাটাচ্ছেন।
👉 আব্দুল লতিফ মিয়া, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী, স্ট্রোকের রোগী—ভাঙা টিনের ঘরে থাকেন।
👉 সফিজ উদ্দিন খান, ৭৫ বছর বয়সী মুক্তিযোদ্ধা—চলাফেরায় অক্ষম, একমাত্র ছেলে বেকার।
👉 রাজেশ্বর হালদারের পরিবার—ভাঙা ঘর রশি দিয়ে গাছে বেঁধে রেখেছেন, তবুও সচ্ছল বলে তালিকায় চিহ্নিত।
তাঁদের কণ্ঠে একটাই প্রশ্ন—“বীরদের ঘর কেন অসৎদের দখলে যাবে?”
তদন্তে বেরিয়ে আসা চাঞ্চল্যকর তথ্য
উপজেলা প্রশাসনের প্রতিবেদন অনুযায়ী,
যেসব মুক্তিযোদ্ধাকে অসচ্ছল হিসেবে ঘর দেওয়া হয়েছে, তাদের অধিকাংশই সচ্ছল।
তাদের মধ্যে কেউ কেউ অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, কারও একাধিক বাড়ি বা জমি আছে।
উদাহরণস্বরূপ—
-
বীর মুক্তিযোদ্ধা রহমান আকনের দুটি বাস ও এক একর জমি আছে।
-
সুলতান হাওলাদার অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক, চার ছেলে ও দুই মেয়ে চাকরিজীবী।
-
আনোয়ার হোসেন হাওলাদারের ছেলেমেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে কর্মরত।
অর্থাৎ প্রকল্পের উদ্দেশ্য যাদের জন্য, তারা বরাদ্দ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
প্রশাসনের অবস্থান ও তদন্তের অগ্রগতি
বর্তমান ইউএনও আবুজর মো. ইজাজুল হক জানান,
“তালিকা প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় অনিয়ম হয়ে থাকলে সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রমাণ পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তদন্তে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা (কৃষি ও মৎস্য কর্মকর্তা) ইতোমধ্যে মাঠ পর্যায়ে যাচাই-বাছাই শেষ করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন।
তবে স্থানীয়রা মনে করেন, দোষীদের বিচারের আওতায় না আনা হলে ভবিষ্যত প্রকল্পও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে।
নৈতিক প্রশ্ন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
একজন মুক্তিযোদ্ধার ঘর মানে কেবল একটি আবাস নয়, এটি তাঁদের আত্মত্যাগের প্রতীক।
তাঁদের ঘর নিয়ে দুর্নীতি বা স্বজনপ্রীতি শুধু অনৈতিক নয়—এটি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা।
যে মুক্তিযোদ্ধারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিলেন, তাঁদের ঘর পাওয়ার যোগ্যতা প্রমাণে এখন লড়াই করতে হচ্ছে—এটাই সবচেয়ে বেদনাদায়ক।
দুমকীর মুক্তিযোদ্ধা আবাসন প্রকল্পের এই অনিয়ম শুধুই প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়—এটি আমাদের মূল্যবোধেরও পরীক্ষা।
যদি প্রকৃত বীররা তাঁদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হন, তবে স্বাধীনতার অর্থই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়।
সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত এই অনিয়মের বিরুদ্ধে দ্রুত ও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া, যাতে ভবিষ্যতে কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ভাঙিয়ে সুযোগ নিতে না পারে।