ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে কিশোরীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে জনতার হাতে আটক ৭৬ বছর বয়সী আব্দুল করিম দাবি করেছিলেন, তিনি নাকি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু অনুসন্ধানে জানা গেছে, তার এই পরিচয় পুরোপুরি ভুয়া। ঘটনাটি ঘটে মশাখালী ইউনিয়নের মুখী গ্রামে, যেখানে এক কিশোরীকে বাড়িতে একা পেয়ে তিনি যৌন নির্যাতনের চেষ্টা করেন। স্থানীয়রা তাকে ধরে গাছে বেঁধে জুতার মালা পরিয়ে পুলিশের হাতে দেন। গ্রেপ্তারের পর তিনি মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিয়ে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু উপজেলা ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের যাচাই-বাছাইয়ে দেখা যায়, সরকারি তালিকায় তার নাম নেই। ফলে নিশ্চিত হয়– তিনি মুক্তিযোদ্ধা নন, বরং সেই পরিচয় ব্যবহার করে দীর্ঘদিন প্রতারণা করে আসছিলেন। এখন আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তার বিচার করা হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ প্রশাসন।
মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান—এই সম্মান, মর্যাদা এবং আত্মত্যাগের ইতিহাসকে শ্রদ্ধা জানাতে সরকার ও জনগণ মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষ মর্যাদা প্রদান করে থাকে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, কিছু অসাধু ব্যক্তি সেই মর্যাদাকে অপব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার চেষ্টা করে আসছে। এমনই এক দৃষ্টান্ত দেখা গেল ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে।
২০২৫ সালের ৪ নভেম্বর দুপুরে উপজেলার মশাখালী ইউনিয়নের মুখী গ্রামে একটি কিশোরীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে স্থানীয়দের হাতে আটক হয় আব্দুল করিম নামে ৭৬ বছর বয়সী এক ব্যক্তি। কিশোরীর বাবার অভিযোগের ভিত্তিতে জানা যায়—সুযোগ পেয়ে করিম তার বাড়িতে প্রবেশ করে এবং কিশোরীকে জোরপূর্বক স্পর্শ করতে থাকে। কিশোরী চিৎকার করলে স্থানীয়রা ছুটে এসে অভিযুক্তকে ধরে ফেলে। ক্ষুব্ধ জনতা তাকে গাছে বেঁধে জুতার মালা পরিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেয়।
মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়! কিন্তু সত্য পুরোটাই ভিন্ন
গ্রেপ্তার হওয়ার পর আব্দুল করিম নিজেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাবি করেন—এতে অনেকেই বিস্মিত ও হতবাক হন। বিষয়টি জানার পর গফরগাঁও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড দ্রুত তদন্ত শুরু করে।
উপজেলা কমান্ডার সাইফুল আলম নিশ্চিত করেন—
“সরকারি তালিকায় আব্দুল করিম নামে কেউ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত নেই।”
জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) কর্তৃক প্রকাশিত ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই’ তালিকা খতিয়ে দেখা হয়। সেখানে ‘মো. আব্দুল করিম’ নামে একজন রয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তার গ্রামের নাম ভিন্ন—মহিরখারুয়া। আর বাবার নামও মেলে না। সুতরাং তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা সেই ব্যক্তি নন যিনি এখন গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে।
পরিচয় জালিয়াতির নতুন রূপ
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন—এই ব্যক্তি দীর্ঘদিন থেকেই মিথ্যা পরিচয়ে সমাজে প্রভাব বিস্তার করতে চাইতেন। বিশেষ করে বয়স, এলাকার অবস্থান ও পরিচয়ের সুযোগ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছেন তিনি।
এমন ভুয়া পরিচয় শুধু প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করে না—জাতির চেতনাকেও আঘাত করে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থান
পাগলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফেরদৌস আলম জানিয়েছেন—
“তিনি মুক্তিযোদ্ধা কি না তা যাচাই বিবেচনার বাইরে; তিনি এখন একটি নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার আসামি।”
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মনোতোষ বিশ্বাস আরও যোগ করেন—
“আইনের মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।”
জনগণের ক্ষোভ ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া
ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাধারণ মানুষের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে। অনেকে বলছেন—
✅ শুধুমাত্র ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় নয়
✅ যৌন অপরাধের বিরুদ্ধে আরও কঠোর ব্যবস্থা প্রয়োজন
কারণ, এ ধরনের অপরাধ সমাজে ভয়াবহ প্রভাব ফেলে এবং শিশু সুরক্ষাকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়।
শেষ কথা
এই ঘটনা আবারও স্মরণ করিয়ে দিল—প্রকৃত বীরেরা কখনো তাদের সম্মানকে অস্ত্র করে না।
আর যারা সেই বীরত্বের মর্যাদাকে অপব্যবহার করে—
তাদের মুখোশ উন্মোচন করা আমাদের সকলের দায়িত্ব।
